হিজলা প্রতিনিধি।।
বহু আলোচিত ও সমালোচিত সাওড়া সৈয়দখালী বালু মহল আজ বরিশালের হিজলা উপজেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে।
ঘটনাস্থল হিজলা উপজেলার হিজলা গৌরাব্দী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংকরপাশা ও কাকুরিয়া গ্রামে অবস্থিত, যেখানে সীমিতসংখ্যক মানুষের বসবাস। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার সুমন সরকার সীমানা নির্ধারণ করে দিলে বালু উত্তোলন শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর বি এন্টারপ্রাইজ।
প্রশাসনের বক্তব্য ও সার্ভেয়ারের উপস্থিতি
সার্ভেয়ার সুমন জানান, তিনি সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে উপস্থিত হয়ে দুপুর ১২টায় ফিরে যান। তার উপস্থিতিতেই বালু উত্তোলন শুরু হয়। তবে ড্রেজারের সংখ্যা, কাগজপত্র, শ্রমিক ও উত্তোলিত বালুর পরিমাণ সম্পর্কে তিনি কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান এবং উপরস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইলিয়াস সিকদার বলেন, “আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেই বালু মহল চালু হয়েছে। সমস্ত বৈধ অনুমতি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে।” তিনি জানান, “চুক্তিটি উন্মুক্ত করার বিষয় নয় এটা বালু মহলের আইনে যা আছে তা এবং সেখানে প্রতিষ্ঠানটির নাম যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বিস্তারিত জনসমক্ষে প্রকাশ করতে এর একটি কপি দেয়া যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন চুক্তিটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের (সরকারের)”।
আর্থিক প্রক্রিয়া ও জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা
২০২৫ সালের ২৪ মার্চ, বাংলা ১৪৩২ সনের ৩০ চৈত্র তারিখে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা বালুমহল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সাত কর্ম দিবসের মধ্যে:
ডি সিআর (Deposit Challan Receipt) এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কোডে অর্থ জমা দিতে হবে
৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হবে
যেখানে উল্লেখ থাকবে:
বালুমহল ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১১ (পরিশিষ্ট-খ) মেনে চলা হবে
নদীর তীর হতে setback রাখা হবে
সেতু বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার উভয় পাশে এক কিলোমিটার এলাকায় বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ
এই আদেশ ১৩ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে ভূমি কমিশনার, হিজলাকে লিখিতভাবে আদেশ করা হয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর বি এন্টারপ্রাইজ দাবিকৃত ১৬ কোটি ৩০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। এতে মূল ইজারার অর্থ, ১৫% আয়কর, ১০% ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অবৈধ অর্থ ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার গুঞ্জন
বালু মহলের ইজারা প্রক্রিয়া নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে কালো টাকার ব্যবহার ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে জোর গুঞ্জন রয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, ইজারার বিশাল অঙ্কের অর্থ কালো টাকার মালিকদের সহায়তায় জমা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই বলছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা নেপথ্যে রয়েছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ঠিকাদার আবুল বাসেদ বলেন, “ব্যবসায়িক পার্টনার থাকা স্বাভাবিক। প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আপনাদের জানানো হবে।” তিনি হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলতাব মাহমুদ দিপু শিকদার এর জড়িত থাকার অভিযোগও নাকচ করেন।
নাটকীয়তা, মামলা, ও গ্রেপ্তার
এই বালু মহলের ইজারা নিয়ে ছিলো নাটকীয় সব ঘটনা—সেনা সদস্যের সাথে হাতাহাতি, রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার, মামলা এবং প্রশাসনিক চাপে উত্তেজনা ছিল টানা আলোচনায়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর অনেকেই হঠাৎ আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এমন অনেকই আজ বালু মহলের “অঘোষিত পার্টনার” হিসেবে পরিচিত।
জনজীবন, জেলেদের জীবন ও নদীর নিরাপত্তা সংকট
সাওড়া সৈয়দখালী বালু মহলের আশপাশের গ্রাম সংকরপাশা ও কাকুরিয়ায় বসবাসকারী লোকজন এখন চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
তাদের দাবি:
ভূমি হারানোর আশঙ্কা
সশস্ত্র অবস্থান ও নিরাপত্তাহীনতা
সামাজিক অস্থিরতা
মেঘনা নদীতে মাছ ধরা নির্ভরশীল জেলেদের অবস্থাও ভয়াবহ।
বালু মহল চালু হলে:
শত শত বলগেট ও ড্রেজার নদীতে চলাচল করে
জেলেদের জাল ছিঁড়ে যায়
মাছ ধরা ব্যাহত হয়
নৌ দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে
জেলেরা জানান, “সবচেয়ে ক্ষমতাবানরা এই মহলের সঙ্গে জড়িত। আমাদের কষ্ট, ক্ষতি—সবকিছুই যেন নীরবতায় ঢাকা পড়ে যায়। আইন আছে, কিন্তু বালু মহল চললে আমাদের জীবনের আইন কাজ করে না।”
বহু জল্পনা, রাজনৈতিক গুঞ্জন, প্রশাসনিক নাটকীয়তা ও জনমনে প্রশ্নের পর অবশেষে চালু হলো হিজলার সাওড়া সৈয়দখালী বালু মহল।
তবে প্রকৃত স্বচ্ছতা, আর্থিক উৎস, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও জনগণের নিরাপত্তা—এই প্রশ্নগুলোর এখনও কোনো পরিষ্কার উত্তর মেলেনি।
জনগণের একটাই দাবি—আইনি প্রক্রিয়ার সবকিছু জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক। নদী, জেলে, পরিবার ও পরিবেশ—সব কিছুর স্বার্থেই স্বচ্ছতা জরুরি।